স্বদেশ ডেস্ক:
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের চতুর্থ দিনে গতকালও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছে রুশ বাহিনী। বিভিন্ন শহরে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যেই রাশিয়া ইউক্রেনের চারটি শহর দখল করেছে দখলদার বাহিনী। এর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভও রয়েছে।
এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নোভা, দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খেরোশেন, পশ্চিমাঞ্চলীয় বারদিয়ানস্ক পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করছে রুশ বাহিনী। এদিকে রাজধানী কিয়েভের আশপাশে ব্যাপক সংঘর্ষ চললেও সেখানে প্রতিরোধ অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করেছেন শহরটির মেয়র ভিটালি কেলিটশকো। গতকাল তিনি বলেছেন, কিয়েভে কোনো রুশ সেনা প্রবেশ করেনি। খবর বিবিসি, রয়টার্স।
রুশ আগ্রাসনের চতুর্থ দিনে গতকাল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন তার সেনাবাহিনীকে পারমাণবিক অস্ত্র হস্তান্তরের ব্যাপারে উচ্চপর্যায়কে ‘বিশেষ সতর্ক’ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগো বলেছেন, পশ্চিমারা ‘অবন্ধুসুলভ’ ‘অবৈধ নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করেছে। তবে কী ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে তা জানা যায়নি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এক প্রতিক্রিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারকে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বলে আখ্যা দিয়েছেন। তবে বিবিসির নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিবেদক জানিয়েছেন, এটি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার সংক্রান্ত ইঙ্গিত নয়।
এদিকে চলমান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এখনই বন্ধ করতে ইউক্রেন ও রুশ প্রতিনিধির মধ্যে বৈঠকের বিষয়টি গতকাল সারাদিনই আলোচনায় ছিল। মস্কো থেকে আলোচনার স্থান বেলারুশকে বেছে নেওয়া হলেও ইউক্রেন তা প্রথমে খারিজ করে দিয়েছিল। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, বেলারুশ ‘ক্রিমিনাল’ রাশিয়ার পক্ষে কাজ করছে এ কারণে সেখানে বৈঠকে যাব না। তবে এ প্রতিবেদন লেখার সময় বিবিসির খবরে বলা হয়, বেলারুশ সীমান্তে প্রতিনিধি পাঠাতে সম্মত হয়েছে ইউক্রেন। জেলেনস্কি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই বেলারুশ সীমান্তে ইউক্রেনের প্রতিনিধি রুশ প্রতিনিধের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছে। প্রিপাত নদীর কাছে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে খবরে বলা হয়েছে। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো সব ধরনের দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি ইউক্রেন প্রতিনিধিদের বৈঠকের স্থানে যাওয়া এবং তাদের নিরাপদে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বৈঠকে রাজি হওয়ার আগে লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে টেলিফোনে কথাও বলেন জেলেনস্কি।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর পশ্চিমা দেশগুলো একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যাচ্ছে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর অধিকাশংই রুশ অর্থনীতিকে ধসিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে আরোপ করা হয়েছে। রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা। এর ফলে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে লেনদেন করতে পারবে না। এছাড়া যে বিষয়টি রুশ অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে তা হলো আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকেও কয়েকটি রুশ ব্যাংককে বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে করে ওইসব ব্যাংক বিশ^বাজারে নিজেদের কার্যক্রম চালু রাখতে পারবে না। এমন নিষেধাজ্ঞার ব্যাংকগুলো অর্থ সংকটে পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় রুশ জনগণ অর্থ তুলে নিতে হামলে পড়েছে। যদিও এমন পরিস্থিতিতে লোকজনকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক বিবৃতিতে ব্যাংকটি জানিয়েছে, রাশিয়ার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আর্থিক খাত সচল রাখতে ব্যাংক অব রাশিয়ার হাতে যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে।
আর্থিক নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি রাশিয়ার আগ্রাসন থামাতে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার জন্য আকাশপথও বন্ধ করে দিচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলো একযোগে আকাশপথ বন্ধ করায় রুশ বিমানগুলো পশ্চিমে যাওয়ার পথ কমই খোলা রয়েছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, সেøাভেনিয়া ও বাল্টিক দেশগুলো সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে তাদের আকাশসীমায় রুশ বিমান প্রবেশের অনুমতি দিবে না। এছাড়া গতকাল জার্মানি নিজেদের আকাশপথ রাশিয়ার জন্য তিন মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। একই পন্থা অনুসরণ করেছে বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও নেদাল্যারল্যান্ডসও। বিশ্লেষকরা জানিয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে বেশ চাপে পড়েছে মস্কো।
ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে গত কয়েকবার চরম উত্তেজনা চলছিল। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন রুশ সেনাকে ইউক্রেনে অভিযানের নির্দেশ দেন। এরপরই ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে তুমুল আগ্রাসন চালায় রুশ বাহিনী। তবে বিভিন্ন শহরে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে ইউক্রেনীয় বাহিনী। গতকাল রবিবার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ দখল করলেও সেখানে সংঘর্ষ চলছিল। এ ছাড়া রাজধানী কিয়েভের আশপাশে তুমুল সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। রাতভর বড় বড় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। কিয়েভের দক্ষিণ-পূর্বের শহর ভেসকিভে একটি তেলের পাম্পে বিস্ফোরণ হয়। সেখান থেকে আগুনের লেলিহান শিখা ও কালো ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শহরটির মেয়র নাটালিয়া বেলাসিনোভিচ বলেছেন, শত্রুরা সব ধ্বংস করে দিচ্ছে।
সব যুদ্ধের মতো ইউক্রেন যুদ্ধেরও বলি হতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। গতকাল পর্যন্ত প্রায় চার লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়ে প্রতিবেশী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া গতকাল পর্যন্ত দুই শতাধিক বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের স্বাস্থ্য বিভাগ। অন্যদিকে ইউক্রেন দাবি করেছে, রাশিয়ার ৪৩০০ জন নিহত হয়েছে যাদের মধ্যে প্যারামিলিটারি ও রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীও রয়েছে।